ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায়-ব্রেন স্ট্রোক এর লক্ষণ

সম্মানিত পাঠক, ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় এবং ব্রেন স্ট্রোকের লক্ষণ সম্পর্কে জানতে আর্টিকেলটি পড়ুন। আজ আমি ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব এবং সেই সাথে ব্রেন স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ কি কি তা আপনাদের সামনে তুলে ধরব। 

আসুন তাহলে দেরি না করে শুরু করা যাক ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় কি কি আমরা জেনে নেই। 

ব্রেন স্ট্রোক এর লক্ষণ:

ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে জানার আগে ব্রেন স্ট্রোকের লক্ষণ গুলো কি কি তা আমাদের আগে জানা- শোনার দরকার। তাই চলুন তাহলে জেনে নেই কি কি লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিলে আপনি বুঝবেন যে আপনার ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে। অথবা কি ধরনের উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা দিলে অন্য ব্যক্তির ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে তা আপনি কিভাবে বুঝতে পারবেন। 

আরো পড়ুন: দুর্বল হার্ট সবল করার উপায় - হার্টের ব্লক দূর করার ব্যায়াম

ব্রেনে বা মস্তিষ্কে হঠাৎ করে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে বা মাথার ভিতরে রক্তক্ষরণের কারণে ব্রেন স্ট্রোক হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, সাধারণত দুই ধরনের স্ট্রোক হয়। একটি হল ইসকিমিক আর অপর টি হলো হেমারেজিক। রক্ত চলাচল যখন হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় তখন তাকে ইসকিমিক স্ট্রোক বলা হয়। 

আর স্ট্রোক করে দুর্বল রক্ত নালী ছিঁড়ে গিয়ে যখন রক্তপাত হয় তখন তাকে হেমারেজিক স্ট্রোক বলা হয়। মস্তিষ্কের প্রত্যেকটি কোষ কাজ করা বন্ধ করতে বা মারা যেতে পারে। যখন মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলি মারা যায় তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা শরীরের অঙ্গ গুলির কার্যকারিতা হারিয়ে যায়। 

ফলে মানুষের বাকশক্তি, শরীরের অনুভূতি, পেশিশক্তি ,দৃষ্টিশক্তি বা স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যেতে পারে। এমনকি প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারে।এরকম অবস্থা হলে কিছু মানুষ সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার হয়। আবার কিছু মানুষ এরকম হলে শারীরিক অক্ষম বা মারা যেতে পারে। কোন ব্যক্তির স্ট্রোক শুরু হওয়ার এক ঘন্টার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

নইলে রোগীর খুব তাড়াতাড়ি শারীরিক অক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে বা ততক্ষণাৎ মৃত্যু হতে পারে।লক্ষণগুলো হচ্ছে-

শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়া-যখন স্ট্রোক হয় তখন শরীরের ভারসাম্য হারানোর মতো সমস্যা দেখা যায়।যাদের স্ট্রোক হয় তারা প্রায়ই ভারসাম্য হারিয়ে বা মাথা ঘোরা অথবা মাথা ভারী হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। এ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কোন কিছু ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অথবা বসে বা শুয়ে ষ থাকতে হয়। মুখ,বাহু এবং পায়ের হঠাৎ দুর্বলতা শরীরের একপাশে প্যারালাইসিসের মতো হতে পারে।

চোখে ঝাপটা দেখা- স্ট্রোক হলে অনেক রোগী চোখে ঝাপসা দেখে বা ঝাপসা হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হয়। এরকম হলে খুব বেশি রোদে হাঁটাহাঁটি করা বা শরীরে পানি কমে যাওয়ার কারণে হতে পারে। তাই এ ধরনের সমস্যা হলে সাবধানতার সঙ্গে চলাফেরা করতে হবে। স্ট্রোক হওয়া রোগীর একটি বা উভয় চোখে ঝাপসা বা কালো হয়ে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে।

মুখ অবস হওয়া-স্ট্রোক হলে মুখের এক সাইডে অবশ হয়ে যায়। এক পাশে নিচের অর্ধেক নিচু হয়ে যাবে বা ঝুলে যাওয়ার মত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সময় কথা বলার সময় মনে হবে মুখের এক পাশ অবশ হয়ে আছে। এবং হঠাৎ করে মুখ বেঁকে যাওয়া। এই ধরনের সমস্যা হলে খুব দ্রুতগতিতে চিকিৎসকের নিকট শরণাপন্ন হতে হবে।

হাত বা বাহূ দুর্বলতা হওয়া-স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাহু খুবই দুর্বল হয়ে যায়। কোন কিছু ধরতে গেলে বা ধরার চেষ্টা করলে সেই হাত থেকে ওই জিনিস আপনা আপনি পড়ে যাওয়ার মত দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় স্ট্রোক হওয়া রোগী শরীরের পেশী গুলো অবশ হয়ে যায় এবং যেদিকে পড়ে যায় সেদিকে বেশি আক্রান্ত হয়। 

এর কারণ হচ্ছে স্ট্রোক হলে শরীরের পেশী গুলো শরীরের ওজন ধরে রাখতে পারেনা। অবস হওয়ার কারণে ধরে রাখার মত কোন শক্তি থাকে না।

কথা অস্পষ্ট হওয়া বা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা-স্ট্রোক হওয়া রোগী কথা বলার সমস্যা দেখা দেখা দিতে পারে।রোগী কারো সামনে কথা বলার সময় দেখা যাবে যে কথা অস্পষ্ট হতে পারে এবং একই কথা বা একই শব্দ বারবার পুনরাবৃত্তি করতে পারে। এমনকি অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলতে পারে।

মাথা ব্যথা- স্ট্রোক হওয়া রোগীর কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ তীব্র মাথাব্যথা হবে। তখন বুঝতে হবে যে ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং তখনই দেরি না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের নিকট যেতে হবে।এছাড়া ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকা, অন্যান্য যে কোন নেশা জাতীয় দ্রব্যের প্রতি আসক্তি ইত্যাদি স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

উল্লেখিত স্ট্রোকের লক্ষণ গুলো কারো যদি দেখা দেয় অথবা উল্লেখিত লক্ষণ গুলোর যেকোনো একটি দেখা দিলে ওই রোগীকে দ্রুত গতিতে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

ব্রেন স্ট্রোক এর কারণ:

ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে জানতে ব্রেন স্ট্রোকের কারণ কি কি সেগুলো আমাদের জানা দরকার। ব্রেন স্ট্রোকের কারণ না জানলে আমরা সতর্কমূলক ব্যবস্থা নিতে পারব না। মেডিকেলের এক গবেষণায় জানা গেছে প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে ১১ জনই ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এই স্ট্রোকের কারণ গুলো নিম্ন রূপ -

  • ব্রেন স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ।
  • শরীরের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হলে।
  • শরীরে হাই ব্লাড প্রেসার ,অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ যদি থাকে তাহলে ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে।
  • অতিরিক্ত টেনশন, মানসিক চাপ,অবসাদের মত মানসিক সমস্যা থাকলে ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • পরিশ্রম না করে সব সময় শুয়ে থাকলে বা বসে থাকলে ওজন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে। সেই কারণে ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • ধূমপান মধ্যপান অ্যালকোহল তামাকজাত দ্রব্য ইত্যাদি সেবন করলে ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে। 
  • অনিয়ন্ত্রিত খাদ্য অভ্যাস, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ব্রেন স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।
  • অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার, চর্বিযুক্ত খাবার, চিনি যুক্ত খাবার, কোমল পানীয়, ভাজাপোড়া খাবার ইত্যাদি খেলে ব্রেন স্টক হতে পারে। 

ব্রেন স্ট্রোক করলে করনীয় কি:

ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে জানতে ব্রেন স্ট্রোক করলে করনীয় কি বা ব্রেন স্ট্রোক হলে কি করা উচিত সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা উচিত এবং এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন সেগুলো হল-

  • নিয়মিত ভাবে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন অভ্যাস করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠা সম্ভব।
  • আপনার শরীরে যদি ডায়াবেটিস থাকে, ব্লাড প্রেসার হাই থাকে, এবং কোলেস্টেরল সমস্যা থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ করলে ব্রেন স্ট্রোক থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
  • পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন এবং তার সাথে অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার, চিনি যুক্ত খাবার, লবণ যুক্ত, ভাজাপোড়া, ফাস্টফুড খাবার এড়িয়ে চলুন।
  • ধূমপান, মধ্যপান, অ্যালকোহল, জর্দা, যেকোন তামাক জাত দ্রব্য এবং যেকোনো নেশা জাতীয় দ্রব্য থেকে বিরত থাকুন।
  • প্রতিদিন নিয়মিত ৮ থেকে ৯ ঘন্টা নিরবছিন্নভাবে ঘুমান।
  • ছয় মাস পর পর আপনার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন এবং সেইসাথে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলুন। 
  • নিয়মিত ব্যায়াম করা, যেমন- সাঁতার কাটা, বাইসাইকেল চালানো, দড়ি লাফানো, খেলাধুলা করা, কাইক পরিশ্রম করা ইত্যাদি ব্রেন স্ট্রোক থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
  • মানসিক চাপ, অতিরিক্ত টেনশন, চিন্তাভাবনা, থেকে দূরে থাকুন। পরিবারের লোকজনের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলুন ,বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে হাসি, ঠাট্টা করুন। সব সময় হাসি, খুশি ,আনন্দে, ফুর্তিতে থাকার চেষ্টা করুন।তাহলে মন ভালো থাকবে।
  • বাইরের খাবার পরিহার করুন। বাড়িতে ভালো পরিবেশে তাজা টাটকা শাকসবজি, মাছ, মাংস রান্না করে খাবেন। কিন্তু লাল মাংস খাবেন না। 
  • তার পারও যদি ব্রেন স্ট্রোক হয় তাহলে রোগীকে একদিকে কাত করে বালিশ ছাড়া মাথা নিচু করে শোয়াতে হবে।
  • রোগীকে খাবারের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

চিকিৎসা-উপরে উল্লেখিত লক্ষণ গুলোর মধ্যে যেকোনো একটি দেখা দিলেই দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের অভিজ্ঞ চিকিৎসকের নিকট পৌঁছাতে হবে। চিকিৎসকদের মতে, স্ট্রোক শুরু হওয়া মাত্রই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া গেলে থেরেম্বোলাইসিস চিকিৎসার মাধ্যমে উন্নত সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে এবং এ ধরনের চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীদের দ্রুত পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

আরো পড়ুন :ব্রেস্ট ক্যান্সার কি নিরাময় যোগ্য- ব্রেস্ট ক্যান্সার কি ভালো হয়

স্ট্রোকের চিকিৎসার সাথে সাথে এর কারণ ও জটিলতার চিকিৎসা করতে হবে। ডায়াবেটিস ও হাই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। ধূমপানের অভ্যাস থাকলে ছাড়তে হবে। হৃদরোগ থাইরয়েড এর সমস্যা, কিডনি রোগের সমস্যা অথবা রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকলে প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং প্রয়োজনে ফিজিওথেরাপির বিশেষ প্রয়োজন হতে পারে।

মেডিকেলে নেওয়ার পর রোগীকে চিকিৎসক অবস্থা বুঝে বা লক্ষণ অনুসারে রোগীর মাথার সিটি স্ক্যান ,ব্লাড সুগার পরীক্ষা করে থাকেন এবং পরবর্তীতে রোগীর অবস্থা বুঝে এমআরআই ও সিটি এনজিও গ্রাম করার পরামর্শ দেন। এসব টেস্ট গুলোর রেজাল্ট দেখেই ডাক্তাররা রোগীর চিকিৎসার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। 

  • রোগীর যদি রক্তপাতের কারণে স্ট্রোক হয় তবে চিকিৎসার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। 
  • রোগীকে ঔষুধ দিতে হবে যা স্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধা দূর করে রাখে। 
  • মস্তিষ্কের রক্ত অপসারণ বা চাপ কমানোর জন্য সার্জারি করতে হবে। 
  • ছেঁড়া রক্তনালী বা ভেঙ্গে যাওয়া রক্তনালী ঠিক করার জন্য সার্জারি করতে হবে। 
  • ওষুধ দিয়ে মস্তিষ্কের ফোলা প্রতিরোধ করানো হয়ে থাকে।

স্ট্রোক করা সব রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। তবে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, খিচুন, যদি অজ্ঞান হয়ে যায়, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল মাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদি থাকলে হাসপাতালে ভর্তি প্রয়োজন হবে। তবে উপরোক্ত ব্রেন স্ট্রোকের লক্ষণগুলো দেখা দিলে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে ওষুধের মাধ্যমে তা সমাধান করা সম্ভব হতে পারে।

ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায়: 

এ পর্যায়ে আমরা ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে আলোচনা করব। আশা করছি আপনি এই পোস্টের সঙ্গেই থাকবেন। মানুষের জীবনে স্ট্রোক হচ্ছে একটি জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা। তাই দ্রুত এর চিকিৎসা না নিলে রোগী পঙ্গু হওয়ার পাশাপাশি তার মৃত্যু হতে পারে। 

তাই ব্রেন স্ট্রোক থেকে কিভাবে বাঁচা যায়  সে সম্পর্কে আমাদের জানা খুবই জরুরী এবং সেইসাথে স্ট্রোক হওয়া রোগীর ততক্ষণাৎ চিকিৎসা দিতে পারলে অনেক বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আমাদের মস্তিষ্কে যখন আঘাত হানে তখন স্ট্রোকের সম্ভাবনা হয়ে থাকে। 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্ত সরবরাহ যখন বন্ধ হয়ে মস্তিষ্কের কোষগুলো মরে যায়  তখন স্ট্রোক হয়। চিকিৎসকরা বলেন, স্ট্রোক থেকে বাঁচার জন্য নিম্নে উল্লেখিত উপায় গুলো অবলম্বন করা যেতে পারে-

  • স্ট্রোক হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে বিছানায় অথবা ঘরের মেঝেতে অথবা বারান্দার মেঝেতে কাত করে শুইয়ে দিয়ে এ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে এবং সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার মধ্যে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • শুয়ে থাকা রোগীকে বাতাস দিতে হবে অথবা ভালো আলো বাতাস চলাচল করে এমন স্থানে রাখতে হবে। রোগীর আশেপাশে কান্নাকাটি করা চলবে না।
  • রোগী গায়ে থাকা পোশাক ঢিলে ঢালা রাখতে হবে যেন রোগী ঠিকঠাক মতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে নিতে পারে। অথবা রোগীকে খালি গায়ে অথবা ঢিলে ঢালা সিঙ্গেল গেঞ্জি গায়ে দিয়ে রাখা যেতে পারে।
  • স্ট্রোক  করা রোগী যদি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তাহলে রোগীর মুখ খুলে দেখতে হবে মুখের ভিতর কোন কিছু আটকে আছে কিনা। থাকলে তা ভেজা কাপড় দিয়ে খাবারের অংশ বা বমি পরিষ্কার করে দিতে হবে।
  • স্ট্রোক করা রোগীকে এই মুহূর্তে পানি বা কোন কিছু খাবার বা কোন ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে চিকিৎসক সেটা ব্যবস্থা নেবেন।
  • স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর থেকে তিন থেকে চার ঘন্টা এই সময়টুকু খুবই জটিল। এ সময়ের মধ্যে বা তার আগে রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হলে মৃত্যু ঝুঁকি অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব।
  • চিকিৎসকরা স্ট্রোক করা রোগী কে ৪ ঘন্টার মধ্যে আইভি থ্রোম্বোলাইসিস চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। উনারা ইঞ্জেকশনের সাহায্যে একটি ওষুধ প্রয়োগ করেন। যা রক্ত নালীর ব্লক ছেড়ে দিয়ে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক হয়ে যায়। চিকিৎসকদের ভাষায় এই পদ্ধতিকে বলা হয় থ্রোম্বোলাইসিস। এ ধরনের চিকিৎসা মাধ্যমে বেশিরভাগ রোগের ক্ষেত্রে সুস্থ হয়ে রোগী বাড়ি ফেরেন। 

ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় এবং ব্রেন  স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে আপনি নিচের সাধারণ নির্দেশনা গুলি অনুসরণ করুন-

স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা-একটি ব্রেন স্ট্রোক থেকে কিভাবে বাঁচা  যায়  এবং ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে পারে সেটা হল স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা বজায় রাখা। স্বাস্থ্যকর জীবনধারা এর মধ্যে রয়েছে ফলমূল ,শাকসবজি, শস্য, চর্বিহীন খাবার ইত্যাদি। ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপান ,অ্যালকোহল , তামাক জাত দ্রব্য সেবন করা থেকে বিরত থাকুন।

নিয়মিত শরীর চর্চা: ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে বাঁচার উপায় গুলোর মধ্যে নিয়মিত শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করা একটি অন্যতম প্রধান উপায়।  নিয়মিত ব্যায়াম করা যেমন হাঁটাহাটি করা, বাইসাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা,খেলাধুলা করা, দড়ি লাফানো, জগিং করা ইত্যাদি ব্যায়ামগুলো করলে ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ- ব্লাড হাই প্রেসার স্ট্রোকের একটি প্রধান ঝুঁকির কারণ হতে পারে। নিয়মিত আপনার ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা করুন। প্রয়োজনে নিয়মিত ঔষধের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন। এক্ষেত্রে ব্যায়াম করা, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা,কম সোডিয়ামযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা ইত্যাদি।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ- ডায়াবেটিসের মাত্রা বেশি হলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।তাই আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে ব্যায়াম এর মাধ্যমে,  ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী খাবার ,ওষুধ ব্যবহার করে আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

দেহের স্বাভাবিক ওজন- অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি এবং স্থলতা সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ। নিয়মিত ব্যায়াম, ডাক্তারের পরামর্শ এবং সুষম খাদ্য অবলম্বন করে আপনার ওজন স্বাভাবিক রাখবেন।

কোলেস্টেরলের মাত্রা- উচ্চমাত্রার অথবা খারাপ কোলেস্টেরল থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে সাহায্য করে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে চলুন এবং ডাক্তারের দেওয়া কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সমস্ত ওষুধ লিখে দিবেন সেগুলো নিয়মিত খান।

ধূমপান ত্যাগ করুন- ধূমপান রক্ত নালীর প্রচন্ড ক্ষতি করে এবং এবং অস্বাভাবিকভাবে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। তাই ধূমপানের অভ্যাস থাকলে আপনি খুব তাড়াতাড়ি ধূমপান বাদ দিন এবং অন্যান্য নেশা জাতীয় সবকিছু পরিত্যাগ করুন।

অতিরিক্ত মদ্যপান/ অ্যালকোহল: অতিরিক্ত মদ্যপান অ্যালকোহল তামাকজাত দ্রব্য রক্তচাপ বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। সুতরাং অ্যালকোহল জাতীয় অথবা নেশা জাতীয় যত উপাদান আছে সব পরিহার করুন। 

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: শুধু ব্রেন স্ট্রোক নয়, আপনার স্বাস্থ্যের যেকোনো সমস্যা দূরীকরণের ক্ষেত্রে আপনার নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। অন্তত কমপক্ষে বছরে দুইবার ব্রেন স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, হাই প্রেসার, লো প্রেসার ,হার্ট অ্যাটাক, ব্লাড টেস্ট, ইসিজি, সিটি স্ক্যান, এম আর আই ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের রোগের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে স্ট্রোক হওয়ার খুব একটা ঝুঁকি থাকে না।

কারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যদি কোন সমস্যা ধরা পড়ে তখন চিকিৎসা করে সেটা সমাধান করা যাবে।

ব্রেন স্ট্রোক রোগীর খাবার তালিকা:

ব্রেন স্ট্রোক হচ্ছে একটি প্রাণঘাতী রোগ। এ রোগ হলে মানুষের চিন্তার সীমা থাকেনা। তাই ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত উপরের অংশে আলোচনা করেছি। এখন এ পর্যায়ে ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় গুলোর মধ্যে খাবার তালিকা হচ্ছে একটি অন্যতম প্রধান উপায়। 

ব্রেন স্ট্রোক প্রতিরোধে নিয়ন্ত্রিত খাদ্য অভ্যাসে রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। কিছু কিছু খাবার যেমন-ফলমূল, শাকসবজি এগুলো নিয়মিত খেলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সহজ হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি৬০ সেকেন্ডে ৩০ জন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় এবং প্রতি 60 সেকেন্ডে ১৫ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন।

 

বিশ্বজুড়ে স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮ কোটিরও বেশি। তাই ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে কি কি খাবার খাওয়া প্রয়োজন সে সম্পর্কে আলোচনা করব-

আঁশ জাতীয় খাবার-আঁশ  জাতীয় খাবার পরিপাকতন্ত্রের কোলেস্টেরলের সঙ্গে আবদ্ধ হতে সাহায্য করে এবং এটি রক্ত প্রবাহ শোষিত হতে বাধাগ্রস্ত করে। এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে এবং স্ট্রোক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। কোলেস্টেরল কে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ গ্রাম ফাইবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। 

খাবারের মধ্যে রয়েছে ওটামিল, সিম জাতীয় খাবার, মটর,শীম, ডাল, বারলি, ফল ও সবজি, কমলা ,আপেল, গাজর ইত্যাদি।

শাকসবজি ও ফলমূল- ফল এবং শাক সবজির মধ্যে রয়েছে এন্টি অক্সিডেন্ট এর ভালো একটি উপাদান যা ফ্রি রেডিকেলের কারণে বৃষ্টি হওয়া ক্ষতি থেকে শরীরকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শরীরের অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করতে শাকসবজি এবং ফলমূল প্রচুর উপকারী। 

সেই সাথে স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের মত কঠিন রোগ সহ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। এছাড়া শাকসবজিতে রয়েছে পটাশিয়াম। যা গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি ফল থেকে পাওয়া যায় পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে একটি প্রধান ঝুঁকির কারণ। 

চিকিৎসকরা বলেন, যারা পটাশিয়াম বেশি বেশি করে গ্রহণ করেছেন তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কম পটাশিয়াম বেশি থাকে কিছু ফল ও শাকসবজি হলো কলা, ডাবের পানি, আম, বরই, লেবু, কমলালেবু, আলু, টমেটো, গাজর, ফুলকপি ইত্যাদি যা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।

সামুদ্রিক মাছ-গবেষকদের মতে, সমুদ্রের মাছ স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। সপ্তাহে অন্তত দুইবার করে ভাজা ছাড়া সামুদ্রিক মাছ খেলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে। যেমন স্যামন মাছ ,টুনা মাছ, মেকেরেল মাছ ইত্যাদি আমাদের ধমনীতে প্রদাহ কমাতে এবং রক্তের গতি প্রবাহ সঠিক রাখতে সাহায্য করে এবং এটি রক্ত জমাট বাধার ঝুঁকি হ্রাস করতে সাহায্য করে যা স্ট্রোকেরএকটি প্রধান কারণ।

বেরি জাতীয় ফল-বেরি জাতীয় ফল যেমন স্ট্রবেরি, বুলুবেরী, ব্ল্যাকবেরি এবং চেরি ফল এর মধ্যে এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকার কারণে দেহে প্রদাহ কমাতে এবং রক্তনালী গুলিকে প্রসারিত করতে সাহায্য করতে থাকে। যা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। 

এছাড়া এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া আপনার দীর্ঘ স্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে এবং আপনার শরীরে সমস্ত স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সাহায্য করতে পারে। তাই আপনার খাবার তালিকা বড় ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে বেরি জাতীয় ফল রাখতে পারেন ।

বাদাম- চিনা বাদামের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন, ফাইবার ইত্যাদি যা কোলেস্টেরল কমাতে এবং হার্টের স্বাস্থ্য উন্নতি করতে সহায়তা করে। বিভিন্ন ধরনের বাদামের মধ্যে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট যা দেহের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। আখরোট বাদাম হার্টের জন্য ভালো। 

এগুলি ওমেগা-৩ ফ্যাটি এ্যাসিডের একটি ভালো উৎস যা প্রদাহ কমাতে এবং হার্টের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাদাম গুলো কোলেস্টেরল কমাতে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। সুতরাং স্ট্রোক করা রোগীর জন্য নিয়মিত বাদাম খাওয়া ভালো।

দুগ্ধ জাত খাবার-একটি গবেষণায় দেখা গেছে যারা বেশি পরিমাণে  দুগ্ধ জাত পণ্য ও পনির খান তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি কম থাকে ।এটি দুগ্ধজাত দ্রব্য, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়ামের একটি ভালো উৎস হওয়ার কারণে এই পুষ্টিগুলি রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে যা স্ট্রোকের জন্য বড় ধরনের একটি ঝুঁকির কারণ। 

আরো পড়ুন: জরায়ু ক্যান্সার হলে কি মানুষ মারা যায় জানতে চোখ রাখুন

সুতরাং নিয়মিতভাবে আপনি যদি দুগ্ধ জাত খাবার আপনার খাবার তালিকা রাখতে পারেন। তাহলে শুধু স্ট্রোক নয়, অন্যান্য বড় ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

শেষ কথা- ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায়:

প্রিয় পাঠক, আর্টিকেলের শেষ প্রান্তে এসে আমি এই কথা বলে শেষ করে দিব যে ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায়, ব্রেন স্ট্রোকের লক্ষণ, ব্রেন স্ট্রোক রোগীর খাবার তালিকা, ব্রেন স্ট্রোক হলে করনীয় কি, ব্রেন স্ট্রোকের কারণ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আপনি হয়তো বা আমার এই পোস্টের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত থেকে পড়েছেন এবং উপকৃত হয়েছেন ।

এতক্ষণ ধরে এই পোষ্টের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।আপনি দয়া করে ব্রেন স্ট্রোক সম্পর্কে কমেন্টস এবং শেয়ার করে অন্য ব্যক্তিদেরকে জানিয়ে দিন ।যেন তারাও এই পোস্টটি পড়ে উপকৃত হতে পারেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url